বাংলা এমন একটি রাজ্য, যেখানে রাজনীতির শিকড় সবসময়ই মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে। দেশভাগের পর পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে বিপুল বাঙালি শরণার্থী এসে পড়েছিলেন, তাঁদের বাঁচার যুদ্ধ এই রাজ্যে রাজনীতির দিশা বদলে দিয়েছিল। বাড়িঘরহীন, জমিহীন, কিছু হারানোর নেই—এমন মানুষদের সামনে একটাই প্রশ্ন ছিল: খাবো কীভাবে? বাঁচব কীভাবে? এই প্রশ্ন ধর্মের ছিল না, ছিল অর্থনীতির। তাই বাংলায় রাজনীতির মূল সুর হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক ন্যায়, সামাজিক সুরক্ষা এবং জীবিকার অধিকার।
ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হল বামপন্থার উত্থান। শরণার্থী কলোনিতে বামপন্থীরা মানুষের পাশে দাঁড়াল। খাদ্য আন্দোলন, শ্রমিক অসন্তোষ, জমিহীন কৃষকের দাবি—এসবের সঙ্গে বামের পরিচয় মিশে গেল। বাংলার রাজনীতিতে তখন ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্ন তেমন জায়গা পেল না। কারণ সাধারণ মানুষ জানত—গৃহহীনতার যন্ত্রণা হিন্দু-মুসলমান আলাদা করে দেখে না।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। সেদিন মানুষের আশা ছিল—যে দল এতদিন রাস্তায় সংগ্রাম করেছে, তারা এবার ক্ষমতা নিয়ে মানুষের হাত শক্ত করবে। সত্যিই, ভূমি সংস্কার বাংলার সামাজিক কাঠামো বদলে দিল। “অপারেশন বর্গা”র মাধ্যমে ভুমিহীন কৃষকেরও জমিতে অধিকার জন্মাল। ছোট কৃষক, বর্গাচাষি—যাঁরা এতদিন অন্যের জমিতে চাষ করতেন তাঁদের জীবন পাল্টানোর সুযোগ এল। গ্রাম বাংলায় প্রথমবার ক্ষমতার স্বাদ পেল সাধারণ মানুষ। এই সময় বাংলার কৃষি যেমন উন্নত হল, তেমনি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও মানুষের প্রতি আস্থা তৈরি হল।
কিন্তু বাম রাজনীতির এই সোনালি সাফল্য একসময় হোঁচট খেল শিল্পায়নের প্রশ্নে। দীর্ঘ সময় ধরে বামফ্রন্ট শিল্পোন্নয়নে পিছিয়ে রইল। নতুন কারখানা এল না, পুরনোগুলি পড়ে রইল। শিক্ষিত তরুণেরা চাকরি খুঁজতে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ছুটল। বামের কৃষিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধীরে ধীরে সীমায় এসে দাঁড়াল। তখনই বাম নেতৃত্ব বুঝল—এগোতে হলে শিল্প চাই।
একুশ শতকে বাম সরকার শিল্পায়নের পথে হাঁটতে চাইল। কিন্তু এই সময়েই এল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম। গাড়ির কারখানা স্থাপনের জন্য উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত—এখানেই ভুল শুরু। জমির মালিকদের বেশিরভাগই ক্ষতিপূতি মেনে নিয়েছিলেন; কিন্তু যে অসংখ্য কৃষিশ্রমিক জমিতে কাজ করতেন, যাঁদের নাম জমির খতিয়ানে নেই—তাঁদের জীবিকার কথা ভাবা হলো না। তাঁরা ছিলেন মূলত নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলিম। অর্থাৎ যাঁদের জন্য একসময় বাম রাজনীতি জন্মেছিল, শিল্পায়নের নামে তাঁদেরই অন্ধকারে ফেলে রাখা হল।
এই ক্ষোভ থেকেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন মাথা তুলল। মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করল—উন্নয়ন কার জন্য?
এই ভুলই বামের তিন দশকের শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিল। ২০১১ সালের ভাঙন তাই কেবল নির্বাচনী হার নয়—এটা ছিল মানুষের আক্ষেপ।
আজ বামপন্থার সংকট আরও গভীর। ভোটব্যর্থতা তো আছেই, বড় সমস্যা হলো—তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব। কৃষক-শ্রমিক-মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব কমে গিয়েছে। নেতৃত্বের বড় অংশ শহুরে ছাত্র-রাজনীতির ভরসায় দাঁড়িয়ে। ফলে গ্রামের মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ মনে করছেন—এই বাম দল তাঁদের আর ঠিক চিনতে পারে না।
বাংলার রাজনীতি আজ দুই অতিরিক্ত মেরুতে টানছে—একদিকে কল্যাণভিত্তিক রাজনীতি, অন্যদিকে পরিচয়ভিত্তিক (আইডেন্টিটি) রাজনীতি। মাঝখানে যে অর্থনৈতিক ন্যায়ের রাজনীতি, যে রাজনীতি একদিন বামপন্থাকে শক্তি দিয়েছিল—সেটা এখন দুর্বল। ফলে বাংলার জনগণ এখন প্রায় বাধ্য—একটি চরম পছন্দের মধ্যে বেছে নিতে।
তাহলে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কোথায়?
যদি তারা আবার মাটির মানুষের কাছে ফিরে যায়, জমিহীন কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, সংখ্যালঘু ও শরণার্থীর রাজনীতি সামনে আনে—তবে বাংলার রাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরে আসতে পারে। শিল্পায়ন হোক, কিন্তু মানুষের অধিকারকে সঙ্গী করে। গ্রামবাংলার কণ্ঠ আবার রাজনীতির কেন্দ্রে আসুক।
আর যদি বামপন্থা এই চ্যালেঞ্জ নিতে না পারে—তবে বাংলার রাজনীতি আরও একমুখী হবে। তখন হয়তো উন্নয়ন আর পরিচয়ের টানাপোড়েনেই রাজ্যটা আটকে থাকবে। সেই জায়গায় শ্রেণি-সমতার ভাষা, দাবি-দাওয়ার রাজনীতি, মানুষের অধিকার—সবটাই কমে যাবে।
উপসংহারে বলা যায়—
বামপন্থার ইতিহাস বাংলার মানুষের সঙ্গে লেখা।
তার পতনও মানুষের আক্ষেপে লেখা।
এখন প্রশ্ন—বাম কি নতুন করে নিজেকে মাটির মানুষের পাশে দাঁড় করাতে পারবে? নাকি বিপ্লবের গল্প শুধু স্মৃতিতেই বন্দি থাকবে?
বাংলা এখনো অপেক্ষায়—
কেউ আবার এসে বলবে,
এ রাজনীতি তোমার—যে তুমি মাটিতে ঘাম ঝরাও।