শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা: একটি বাস, বহু মনের পথচলা

শিলিগুড়ির ভোরে কুয়াশা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটা যেন অপেক্ষা করছিল দূরপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাহাড়ের ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলে মানুষগুলো একে একে উঠে আসে সেই বাসে—কারো হাতে হাসপাতালের রিপোর্ট, কারো চোখে নতুন চাকরির আশাবাদ, কারো মনে ছেলের পড়াশোনার দায়। বাসটা দাঁড়িয়েই আছে যেন এক চলমান বাংলার মানচিত্র। শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি—উত্তরবঙ্গের ভাঁজ খুলে গিয়ে কলকাতার আলো-পথে ঢালা হবে তাদের স্বপ্ন।

জানালার সিটে বসে গীতিকা পাহাড়ের নীল ছায়াকে ফিকে হতে দেখে। শহরে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনা, নিজের পরিচয় তৈরি করা—এটাই তার লক্ষ্য। তবে একটা অদৃশ্য চাপ তাকে ঘিরে—ভাষা, উচ্চারণ, পোশাক… তার পরিচয় কি শহরের ভিড়ে তাকে আলাদা করে দেবে? পাহাড়ে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে হয় না, শহরে কি বারবার প্রমাণ দিতে হবে? নিজের স্বাধীনতাটাই তাই এখন তার সবচেয়ে বড় ইচ্ছে।

তার ঠিক পিছনে বসা মঞ্জুর হাতে কাপড়ের ব্যাগ আর মনের ভেতরে বাস্তবতার অঙ্ক। চা-বাগানের শ্রমিক সে। মাস শেষে তার নামে যে সামান্য টাকা আসে, সেটাই তাকে বদলে দিয়েছে—অন্যের ওপর নির্ভরশীল গৃহিণী থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া একজন মানুষ। এ সহায়তা তাকে বুঝিয়েছে—গরিব হলেও সম্মান পাওয়ার অধিকার আছে সবার। তার ভাবনা একটাই—আজকের দিনটা যদি একটু ভালো কাটে, তাহলে বাচ্চার আগামীটা আরেকটু উজ্জ্বল হবে।

বাসের সামনে তরুণ সিং স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে। এই রাস্তায় তার জীবনের সব লড়াই। আইন-শৃঙ্খলার ঢিলেমি দেখলে তার বুক ধড়ফড় করে—কারণ রাস্তায় শান্তি না থাকলে রুট বন্ধ হতে কতক্ষণ? তার কাছে ভালো থাকা মানে—ঝামেলা কম থাকা। উন্নয়নের বড় বড় কথা তার মাথায় যায় না; সে জানে, শান্ত পথে চাকা ঘোরালে সংসারও ঘোরে।

পিছনের দিকে একা বসে আছে ফারুক। দুবাইয়ে কাজ পেয়েছিল, থাকতও। কিন্তু ভিসা বাড়েনি, ফিরতে হয়েছে। সঞ্চয় খুব বেশি নেই। তার চোখে কলকাতা এক নতুন সুযোগ। ঘর ছেড়ে দূরে যেতে যে কষ্ট সে চেনে, তাই এখন স্বপ্ন—বাড়ির কাছেই একটা মানসম্মত রোজগার। মাটির কাছে থাকা—এটাই তার উন্নতি।

আরও পিছনে নবদম্পতি—ঋতুপর্ণা আর অরুণ। দু’জনের দু’রকম চাওয়া—অরুণ চায় স্থির আয়, ঋতুপর্ণা চায় নিজের পড়াশোনার মর্যাদা পেতে। তবে তাদের হাসিখুশি কথাবার্তা প্রমাণ করে—সংসারের লক্ষ্য একই: ভালো থাকা, যতটা নিজের মতো থাকা যায়

বাসের জানালার বাইরে দৃশ্য পাল্টাতে পাল্টাতে
— চা-বাগানের সবুজ
— নদীর ধূসর জল
— বাজারের কোলাহল
এসব একে একে বলে দেয়—কোথাও অভাবের চাপে সিদ্ধান্ত জন্মায়, কোথাও সুযোগের টানে। পথে এক ধাবায় চায়ের কাপে ভাঁজ খোলে—দাম, চাকরি, রাস্তা, মেয়েদের নিরাপত্তা—সবকিছুতে ছোট ছোট অভিযোগে লুকিয়ে থাকে বড় বড় চাহিদা। কেউ তারা সেগুলোকে রাজনীতি বলে না, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাই পরে ভোটবুথে হাত নির্দেশনা দেয়।

কলকাতার প্রথম ট্র্যাফিকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাসের ভেতরের প্রত্যাশাও বদলে যায়। পাহাড়ের মেয়ে দেখে শহরের আলো, যা তাকে টানে আবার ভয়ও দেখায়। মঞ্জু ভাবে—এত আলো কি তার ঘরে পৌঁছাবে? ফারুক ভাবে—এটাই কি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ? ঋতুপর্ণা ভাবে—এই শহর তার যোগ্যতাকে চিনবে তো?

সবাই নেমে যায় নিজের যাত্রায়। তাদের পথ আলাদা, অভিজ্ঞতা আলাদা, কিন্তু ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার একটাই। কয়েকদিন পর, হয়তো এই একই মানুষরা বুথের এক লাইনে দাঁড়াবে—কোনো সিট নম্বর নয়, কোনো পরিচয় ছাড়া। সেই মুহূর্তে—

গীতিকার স্বাধীনতা,
মঞ্জুর ন্যায্যতা,
ফারুকের কাজের আশা,
তরুণের শান্তি,
ঋতুপর্ণা-অরুণের সংসারের স্বপ্ন—

সব মিলেই আঙুলের চাপে লেখা হবে বাংলার আগামী।

কেউ এখানে উচ্চকণ্ঠে দল-রাজনীতি বলেনি,
কেউ স্লোগান দেয়নি,
তবুও পুরো পথটাই রাজনীতিতে ভরা—
খুব নীরবে।
খুব জীবনের মতো করে।

কারণ গণতন্ত্র আসলে এই লম্বা বাসযাত্রার মতোই—
যেখানে প্রতিটি বাঁকে বদলে যায় মানুষের ভাবনা,
আর শেষমেশ সবাই নেমে পড়ে
নিজের সিদ্ধান্তের সঙ্গে।

শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার পথে
বাংলা একটু একটু করে বলে ওঠে—

কোথা থেকে আসছি আমরা,
আর কোথায় যেতে চাই।

Leave a Reply