আজকের বাংলা রাজনীতির তিন ইঞ্জিন: পরিচয়, কল্যাণ ও দুর্নীতি — একটি বর্ণনামূলক পাঠ


শীতের সকালে নদিয়ার কোনো কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়ালে প্রথমেই চোখে পড়ে কয়েকশো ছেলেমেয়ে—হাতে নোট, চোখে দুশ্চিন্তা, বুকের ভিতরে অনিশ্চয়তা। তারা সবাই টেট বা এসএসসির পরীক্ষার্থী, আর তাদের কথার মধ্যে মিশে থাকে আশা, হতাশা, ক্ষোভ ও অপেক্ষা।
এই দৃশ্যের ঠিক বিপরীতে, বাগুলার কোনো বাড়িতে দুপুরে রান্নাঘরের ধোঁয়া উঠতে উঠতে, একজন গৃহবধূ মোবাইলে হঠাৎ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের এসএমএস দেখে থমকে দাঁড়ান—আগুনের আঁচ কমে যায়, কিন্তু চোখে একরকম নিশ্চিন্ত স্বস্তির আলো জ্বলে ওঠে।
আর উত্তরবঙ্গের কোনো রাজবংশী পাড়ায় সন্ধ্যেবেলা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে যখন কেউ ‘অনুপ্রবেশ’ বা ভোটের কথা তোলে, তখন আলোচনাটা এমনভাবে উথলে ওঠে যেন বহুদিনের চেপে রাখা ব্যথা আচমকা বেরিয়ে পড়েছে।

এই তিনটি আলাদা, ছড়ানো, দৈনন্দিন দৃশ্যই মিলে আজকের বাংলার রাজনীতির গল্প বলে।
যেখানে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু তিনটি জোরালো স্রোত—
পরিচয়ের জাগরণ, কল্যাণনীতির হাতছানি, আর দুর্নীতি–বেকারত্বের গভীর ক্ষত।


১. পরিচয়ের রাজনীতি: বাংলার ভিতরে লুকিয়ে থাকা বহু ইতিহাসের সংঘর্ষ

বাংলার রাজনীতি একসময় ছিল জমি-সংস্কার, কৃষক, শ্রমিক—এই শব্দগুলোর মধ্যে আটকে।
কিন্তু ধীরে ধীরে সেই পুরনো বয়ান ভেঙে বেরিয়ে এসেছে নতুন এক সত্তা—পরিচয়
এখন রাজনীতি বোঝার জন্য গ্রাম-শহরের পথে হাঁটলেই দেখা যায়—মানুষ নিজেকে আগে SC, রাজবংশী, নমশূদ্র, মতুয়া, মুসলিম অথবা বাঙালি হিসেবে চিনতে শুরু করেছে।

উত্তরবঙ্গে রাজবংশী পাড়ায় গেলে দেখা যায়—দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক অবহেলা, ভাঙা রাস্তা, নষ্ট স্কুল ভবন আর স্থায়ী চাকরির অভাব মিলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অভিমান জন্ম দিয়েছে।
কেউ দুধের কাপে চা নেড়ে বলতে বলতে থামে—
“আমাদের ভাষা, আমাদের জমি—আমাদেরকেই তো কেউ জিজ্ঞাসা করে না।”
এই কথার ভিতরে লুকিয়ে থাকে বহুদিনের AFSPA-এর গল্প, শিলিগুড়ির বাণিজ্যিক দাপট, আর কোচবিহারের সীমান্তজীবনের অসম্পূর্ণতা।

দক্ষিণবঙ্গে গেলে সেই একই ব্যথা বদলে যায় একেবারে ভিন্ন রূপে।
বসিরহাট, বনগাঁ, বারাসতের পথে মানুষ যখন ‘কাগজ’ বা ‘নাগরিকত্ব’-এর কথা বলে, তখন বোঝা যায়—এটা শুধু আইনি প্রশ্ন নয়, বরং পরিবারের অস্তিত্ব টিকে থাকার প্রশ্ন।

মালদা–মুর্শিদাবাদের গলিতে মসজিদের আজানের পর চায়ের দোকানে বসে সামনে চলতে থাকা আলোচনা শুনলে বোঝা যায়—এ অঞ্চলে পরিচয় মানে নিরাপত্তার প্রশ্ন, নথির প্রশ্ন, ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা।

এই বিচ্ছিন্ন সব অনুভূতিকে বিজেপি যুক্ত করেছে একটি বৃহৎ বয়ানে—
একদিকে উদ্বেগ, অন্যদিকে প্রতিশ্রুতি, আর তার মাঝখান দিয়ে পরিচয়ের রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
২০১৬-র সামান্য উপস্থিতি থেকে ২০২১-এ ৭৭ আসন—এই উত্থান যেন শান্ত নদী রাতারাতি বন্যার স্রোত হয়ে যাওয়ার মতো।

টিএমসি পাল্টা পরিচয়ের ভিতকে ভর করেছে বাঙালিয়ানার গর্ব, সংখ্যালঘু নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, এবং দলিত–মতুয়া আস্থার প্রদর্শনী দিয়ে।
দুইপক্ষের এই দোলাচলেই বামফ্রন্ট সঙ্কুচিত হয়ে প্রায় অদৃশ্য।

ফলে আজকের বাংলা যেন একটি লম্বা সেতু—
এক দিক থেকে আসে বিজেপির তীব্র পরিচয়-রাজনীতি,
অন্য দিক থেকে আসে টিএমসির বাঙালি–কল্যাণের মিলিত ভাষা,
আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভোটার—দিশাহারা, বিভক্ত, কিন্তু সচেতন।


২. কল্যাণনীতি: বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া নরম রাজনৈতিক হাত

একদিকে পরিচয়ের উত্তাপ,
অন্যদিকে আছে কল্যাণনীতির শান্ত স্পর্শ।

বস্তুত, বাংলায় বহু পরিবার মাসের শেষে জানে—
টাকা পরিমাণ কম হোক, কিন্তু সরকার একটি স্থির প্রতিশ্রুতি ঠিকই রাখে।
এ প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে বড় নাম—লক্ষ্মীর ভাণ্ডার

দুপুরবেলা কোনও বাড়ির উঠোনে শুকনো কাপড় তুলতে তোলা হাতে মোবাইল কাঁপলে,
একটি গৃহবধূর মুখে যে হাসিটা ফুটে ওঠে, সেটাই বাংলার কল্যাণনীতির আসল রাজনৈতিক শক্তি।
কাউকে বলতে শোনা যায়—
“এটা আমার নিজের টাকা। কারও কাছে চাইতে হয় না।”

এই সামান্য বাক্যের ভেতরে আছে বহু প্রজন্মের অভাবের ইতিহাস, আর্থিক অস্বস্তির গল্প, এবং নিজের হাতে অর্থ থাকার গর্ব।

স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া খরচের ভয় কমে।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী মেয়েদের বাড়ির ভিতরে সম্মানের নতুন জায়গা আরও পোক্ত করে।
কৃষকবন্ধু চাষিদের মন খানিকটা শান্ত রাখে।
দুয়ারে সরকার গ্রামে গ্রামে সরকারি অফিসকে মানুষের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেয়।

এই কল্যাণের জাল বাংলার প্রতিটি ঘরের সঙ্গে এক অদৃশ্য সুতো বেঁধে ফেলেছে।
যেখানে রাজনীতি আর দূরের বিষয় নয়—
বরং মোবাইল বার্তার মতোই প্রতিদিনের জীবনের অংশ।


৩. দুর্নীতি, বেকারত্ব ও আইনশৃঙ্খলা: নীরব অন্ধকার যার আলো দূরে দেখা যায় না

তবু—কল্যাণের এই আলোকে ছায়া দিচ্ছে অন্য এক অন্ধকার।
যা পরীক্ষার হল থেকে শুরু করে থানার গেট পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।

যে ছেলেরা-ছেলেমেয়েরা বছরের পর বছর পড়াশোনার পর যখন দেখে, তাঁদের চাকরি আদালতের এক রায়ে হারিয়ে গেল—তাদের চোখের কোণায় যে জল জমে,
সেটা শুধু ব্যর্থতার নয়—এটা ক্ষোভের, অপমানের, এবং হারিয়ে যাওয়া ন্যায়বোধের।

গ্রামের ধূলোমাখা রাস্তায় সন্ধ্যেবেলা ফুটবল খেলার পর আড্ডায় ছেলেরা যখন বলে—
“এখানে কিছু নাই, ভাই। চাকরি পেতে গেলে বাইরে যেতেই হবে”—
তখন বোঝা যায়, বেকারত্ব এখন আর কেবল পরিসংখ্যান নয়,
এটা এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা।

কলকাতা–হাওড়ার পাড়ায় রাত বাড়লে যে ভয় তৈরি হয়,
যে সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে লোকজন ফিসফিস করে কথা বলে,
যে রেশন দোকানে দাঁড়িয়ে মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে—
তাতে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা কেবল পুলিশের দায়িত্বের বিষয় নয়—
এটা সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের অংশ।

দুর্নীতি, বেকারত্ব আর আইনশৃঙ্খলার এই ত্রিমুখী ছায়া
কখন কোথায় কীভাবে প্রতিফলিত হবে—
তা কেউ আগে থেকে বলতে পারে না।
কিন্তু তা যে মানুষের মনে ক্রমশ জমে উঠছে—তা স্পষ্ট।


সব মিলিয়ে—বাংলার ভোটারের মনে যে দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে

উত্তরবঙ্গে পরিচয় জাগরণ ও চাকরির অভাব মিলেছে বিজেপির বয়ানের সঙ্গে।
দক্ষিণবঙ্গে মতুয়া–নমশূদ্রদের নাগরিকত্ব উদ্বেগ মিশেছে টিএমসির কল্যাণের আশ্বাসে।
মালদা–মুর্শিদাবাদে নিরাপত্তার ভাবনা টিএমসিকে এগিয়ে রেখেছে।
শহরে চাকরি, মূল্যবৃদ্ধি ও নিরাপত্তার প্রশ্ন ভোটকে অনিশ্চিত করছে।
গ্রামাঞ্চলে কল্যাণের ভরসা ও যুবকদের অভিবাসন—দুইই টানাটানির ভিত তৈরি করছে।

মানুষ তাই ভোটের সময় তিনটি গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায়—
আমার পরিচয় কী?
আমাকে কে সত্যিকারের সাহায্য করে?
আর আমার ভবিষ্যতের পথ কোন দিকে?


শেষ কথা: বুথের ভিতরে যে আয়নাগুলো জ্বলে ওঠে

২০২৬ সালের বাংলা নির্বাচন কোনো সরল সমীকরণের গল্প নয়।
এটি তিন স্রোতের মিলন—
পরিচয়ের তীব্রতা,
কল্যাণের স্থায়িত্ব,
আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে নীরব ন্যায়বোধ।

ভোটার বুথে ঢোকার মুহূর্তে
প্রতিটি মানুষ তিনটি আয়নায় নিজের মুখ দেখে—

পরিচয়ের আয়না,
কল্যাণের আয়না,
আর ন্যায়–অন্যায়ের আয়না।

যে আয়নায় সে নিজের মুখটাকে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়,
সেই আয়নাই ঠিক করবে বাংলার আগামী পাঁচ বছরের রাজনৈতিক গল্প।


Leave a Reply